শত আশা, আকাঙ্খা আর বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে সম্পাদিত হয়েছিল পার্বত্য চুক্তি। পাহাড়ের মানুষের জন্য যেন ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরটি সেদিনই এসেছিল। ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পাহাড়ের আকাশে অধিকার হারা বঞ্চিত মানুষ আর রাষ্ট্রের যুথবদ্ধ পথচলার শপথে উড়েছিল শ্বেত কপোত।মুক্ত স্বাধীন ডানা মেলা কপোতগুলো সেদিন পাহাড়ের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। অবিশ্বাস, সংশয়,নিপীড়ন আর রক্ত বন্যা’র যবনিকাপাত হওয়ার কথা ছিল সেদিন। আজ ২২ টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে সেই উচ্ছ্বাসমাখা ক্ষণটির। সেদিনের সমসাময়িকে জন্ম নেওয়া পাহাড়ের শিশুটি আজ টসবগে যুবা। এই নতুন প্রজন্মের জন্য কেমন পাহাড় তৈরী করলাম এই ২২ তম বর্ষ পূর্তিতে সেটাই হোক সবার জন্য আলোচ্য বিষয়। এই আলোচনায় নিশ্চয় চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকারী পক্ষ বরাররের মত গতানুগতিকভাবে বুলি আওড়াবে চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি বাস্তবায়ন হয়েছে। অনেকের হিসেবে ৮০ শতাংশ বা তারও বেশি। অন্যদিকে চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপর পক্ষ জনসংহতি সমিতির হিসেব মতে ২৪ টি’র বেশি ধারা বাস্তবায়ন হয়নি। বিষয়টা ২৪ কিংবা ৪৮ এই হিসেবে নয়, আমার মূল কথা হল- কাঙ্খিত শান্তি আজও ধরা দিয়েছে কি না! শ্বেত কপোতগুলোর ডানামেলা এখনো পূর্ণতা পেয়েছে কী না!
এই প্রশ্নটির জবাব দু’টি পক্ষের দাবীর মধ্যে যে বিশাল ফারাক তার মধ্যেই নিহিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর সহপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর পরই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মসনদে যে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো ক্ষমতায় এসেছে তারা কখনোই পাহাড় তথা সমতলের বাঙালি ভিন্ন অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষদের সুনজরে দেখেনি।তার জন্যই বোধহয় পাহাড়ের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আর ভরসা পাননি।অগষতান্ত্রিক শাসনের কালো থাবা অনুধাবন করতে পেরে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন আর পাহাড়ের জুম ক্ষেতে অসংখ্য মানুষকে সংগঠিত করেছিলেন অধিকারের প্রশ্নে। সেই থেকেই বুঝা যায়, কোনো মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না যেমনটি বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ এ বলেছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। কেবল বাঙালি কেন, কোনো মানুষকেই দাবিয়ে রাখা যুক্তিসংগঠ নয়, ন্যায়সংগঠও নয়।সংবিধানে স্বকীয় পরিচয়ে স্বীকৃতি এবং যথাযথ অধিকার না দিয়ে পাহাড়ী মানুষকে দাবিয়ে রাখার যে আয়োজন করেছিল তৎকালীন শাসক’রা তার জন্যই ১৯৭৬-১৯৯৭ পর্যন্ত দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে পাহাড়ে সংঘাত। এই সংঘাত কারোর জন্যই সুখকর নয়। এই অধ্যায় তো অন্তত আমাদের সবাইকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেই বিবেচনায় পার্বত্য চুক্তি একটি মাইলফলক হতে পারত। কিন্তু পাহাড়ের সামগ্রিক পরিস্তিতি বিবেচনায় এটা আজও হয়ে ওঠেনি।
চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবো কেন তা হয়ে ওঠেনি।পাহাড়ী মানুষের বেঁচে থাকার মূল সম্বল- ভূমি। এই ভূমিই তাদের জীবন। এই জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব না থাকলে আসলে আর কিছুই থাকে না।দলিল-দস্তাবেজহীন প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনায় পারষ্পরিক বিশ্বাস এবং সৌহার্দই পাহাড়ী মানুষের কাছে পবিত্র দলিল এবং নির্ভরযোগ্য চৌহদ্দি।কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কী নির্মমভাবে এই জুম্ম জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসে আঘাত করেছে। আশির দশকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতল জেলাগুলো থেকে ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে পাহাড়ে অবৈধভাবে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাছাড়া পাহাড়ে নানা সংঘাত ও অস্থিতিশীল পরিস্তিতির মধ্যে অনেক জুম্ম জনগোষ্ঠীর মানুষ নিজ বাস্তুভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। এই বেদখল হওয়া ভূমিগুলো এখনো ফিরে পাওয়া আর হয়নি। যার জন্য চুক্তির মৌলিক বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হ্েচ্ছ ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা। এই জটিলতা নিষ্পত্তির জন্য চুক্তি মোতাবেক একটি কমিশন গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো বিধিমালায় প্রণয়ন হয়নি।সাথে এই খাতটি হস্তান্তর হওয়ার কথা তিন জেলা পরিষদে যা এখনো হয়নি। যার জন্য এই কমিশন আসলে নাম মাত্রই। যার ফলে এখনো বনায়ন, সেটলার বাঙালিদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ, আইন রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও সম্প্রসারণ এবং পর্যটনের নামে হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহন করা হচ্ছে। অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার কথা আঞ্চলিক পরিষদের। কিন্তু এই পরিষদ পরিচালনার জন্য যে বিধিমালা এবং প্রবিধান দরকার তা এই ২২ টি বছরেও করা হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়নি অনেক মৌলিক বিষয়। এইসব বিষয়ের অন্যতম হলো- আইন-শৃংখলা, স্থানীয় পুলিশ, বন (রিজার্ভ ফরেষ্ট ব্যতীত),ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্য।স্থানীয় পর্যটনের যে বিষয়টি হস্তান্তরিত হয়েছে বলে দেখানো হলেও আসলে সেটা পুরোপুরি হস্তান্তরই হয়নি।যার জন্য পাহাড়ে অবাধে চুক্তিকে লঙ্ঘন করে বিভিন্ন সরকারী সংস্থা, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন রক্ষাকারী সংস্থাও এই পর্যটন খাতে জড়িয়ে গেছে।আর এতদিনকার পার্বত্য তিন জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদ চলছে অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারাই।বিশেষ করে তিন জেলা পরিষদ পরিচালনার ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনাটাই যোগ্যতার মানদন্দ। ফলে জবাবদিহীতা এবং স্বচ্ছতার প্রশ্নে এই পরিষদগুলো পুরোপুরিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং রীতিমত অগণতান্ত্রিক।
মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে আরো অন্যতম হলো তিন পার্বত্য জেলার সদরগুলোতে তিনটি সেনানিবাস এবং আলিকদম, রুমা ও দীঘিনালায় তিনটি সেনানিবাস ব্যতীত বাকী সব অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা থাকলেও এখনো অধিকাংশ ক্যাম্প প্রত্যাহার তো হয়ই নি বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো সম্প্রসারণ করা হয়েছে।সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি পার্বত্য চট্টগ্রামে র্যারের স্থায়ী ব্যাটালিয়ন (৬৭৭ জনের) অনুমোদন করা হয়েছে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম রীতিমত অবরুদ্ধই বলা চলে। এই অবরুদ্ধতার মধ্যে পাহাড়ী জীবনে ‘শান্তি’ অধরাই থেকে গেছে।
পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী যদি সবগুলোই অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হত তাহলে আজ পাহাড়ে সংঘাত,রক্ত ঝরা কিংবা পাহাড়ী নারীদের বাঙালী সেটলার কর্তৃক লাঞ্চনা, ধর্ষণ বা হত্যা থেকে রেহাই মিলত।আমাদের পাহাড় এবং রাষ্ট্র হতে পারত আরো সুন্দর এবং গণতান্ত্রিক। কাজেই পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই চুক্তি বাস্তবায়ন অতীব জরুরী।কিন্তু সেই প্রত্যাশিত ‘শান্তি’ বহনকারী চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন আরো কতদূর?
সতেজ চাকমা
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *